দৈনন্দিন পথনির্দেশিকা
সীমাহীন প্রজ্ঞার দাবি অনুযায়ী আল্লাহ তা আলা কিছু মাস ও দিবসকে অন্যান্য মাস ও দিবসের উপর মর্যাদাপূর্ণ করেছেন। উদ্দেশ্য সৎ কর্ম সম্পাদনে মানুষের প্রেরণা উৎসাহে নতুন মাত্রা সংযোগ করা। অধিক মাত্রায় আমলে সালেহ করে উৎকর্ষ সাধনের পথ সুগম করা। তবে মানব ও জিন জাতির দুষ্টচক্র আল্লাহর বান্দাদেরকে সরল পথ থেকে বিচ্যুত করতে সদা সক্রিয়। তাইতো অবস্থান নিয়েছে সম্ভাব্য সকল পথে যা কিছু উত্তম তা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিতে। আল্লাহর রহমত ও করুণা প্রাপ্তির মৌসুম অসার কর্ম, আয়েশ আস্বাদন, প্রবৃত্তিচর্চা ও অযাচিত সুখ উপভোগের উপযুক্ত সময় হিসেবে উপস্থাপন করে।
পরিচ্ছন্ন হৃদয় তবে ধর্ম বিষয়ে জাহিল, অথবা স্বার্থলুব্ধ ব্যক্তি , ধর্মীয় বা সামাজিক নেতৃত্ব ধরে রাখার লিপ্সা যাকে তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতিনিয়ত এরূপ ব্যক্তিদের শয়তান উৎসাহ প্রদানের পাত্র বানায়। সৎকর্ম চর্চা ও সুন্নত অনুসরণে অধিক মাত্রায় সচেতন হতে হবে এমন মূহুর্তগুলো বিদআতপূর্ণ কর্মকাণ্ডে ভরে দিতে এদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় বহুমাত্রায়। হাস্সান ইবনে আতিইয়া বলেন : কোনো জাতি যে পরিমাণে তাদের ধর্মে বেদআতের ( নব আবিষ্কৃত বিষয়) এর প্রবেশ ঘটায় সে পরিমাণ সুন্নত তাদের মধ্যে হতে উঠিয়ে নেয়া হয়। (১) আইয়ুব সাখতিয়ানি বলেছেন, বেদআত পালনকারী ব্যক্তি শ্রম সাধনায় যত এগোয় আল্লাহর সান্নিধ্য থেকে সে তত পিছোয়। (২)
প্রসিদ্ধ বেদআতপূর্ণ অনুষ্ঠানমালার মধ্যে অন্যতম একটি হল, মুসলিম বিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলে ঘটা করে রজব মাসের বিশেষ দিনক্ষণ উদযাপন। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে সকল দিক থেকে বিষয়টি পর্যালোচনার চেষ্টা করেছি। আশা করি বেদআত ও কুসংস্কারে লিপ্ত ব্যক্তিরা পথের দিশা পাবেন ও শরিয়ত সিদ্ধ পন্থায় আল্লাহর ইবাদত আঞ্জাম দিতে সক্ষম হবেন।
অন্যান্য মাসের তুলনায় রজবের কি ভিন্ন কোনো বৈশিষ্ট্য আছে ?
ইবনে হাজর বলেছেন: রজবের ফজিলত, রজব মাসে রোজা অথবা রজবের সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখের রোজা, এ মাসের বিশেষ কোনো রাত্রি উদযাপন বিষয়ে বিশুদ্ধ ও শরিয়তি দলিল-হওয়ার মতো শক্ত কোনো হাদিস বর্ণিত হয় নি। ইমাম আবু ইসমাঈল আল হারাবি আল হাফেজ এ ব্যাপারটি আমার পূর্বেই নিশ্চিত করে বলেছেন। শুদ্ধ সনদে তা থেকে ও অন্যান্যদের থেকে বিষয়টি আমরা বর্ণনা করেছি। ( ১)
তিনি আরো বলেন, রজবের ফজিলত, রজব মাসের রোজার ফজিলত, অথবা সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখের রোজার ব্যাপারে যে হাদিসগুলো এসেছে তা দুপ্রকার: দুর্বল ও বানোওয়াট। দুর্বলগুলো বর্ণনা করছি আর বানোওয়াট গুলোর প্রতি প্রথমে তড়িৎ ইঙ্গিত দিচ্ছি (২) ও পরে বিস্তারিত বর্ণনায় তা পরখ করে দেখছি।
সালাতুর রাগায়েব :
সালাতুর রাগায়েব এর বর্ণনায় আনাস রা. থেকে একটি মাওজু-বানোয়াট হাদিস এসেছে। বৃহস্পতিবার (রজব মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার) যে ব্যক্তি রোজা রাখবে, তারপর এশার নামাজের পর রাত শেষ হওয়ার পূর্বে বারো রাকাত নামাজ পড়বে, প্রতি রাকাতে এক বার সূরা ফাতেহা পড়বে ও তিন বার ( ইন্না আনযালনাহু ফি লাইলাতিল কাদরি ) পড়বে, ও ১২ বার ( কুল হুআল্লাহু আহাদ) পড়বে, প্রতি দুরাকাত অন্তে সালাম ফিরাবে, নামাজ থেকে ফারেগ হয়ে আমার প্রতি সত্তুর বার দরুদ পাঠ করবে, নামাজের সিজাসমূহে ( সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রাব্বুল মালায়েকাতি ওয়ার রুহ) সত্তুর বার পড়বে, সিজদা থেকে মাথা উঠিয়ে সত্তুর বার ( রব্বিগফির ওয়ারহাম ও তাজাওয়ায আম্মা তালাম, ইন্নাকা আনতাল আযীযু আযাম) পড়বে, আল্লাহ তার প্রয়োজন মিটিয়ে দেবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার আত্মা যার হাতে তার কসম, এই নামাজ আদায় করলে - আদায়কারী পুরুষ হোক বা নারী - আল্লাহ তার সমস্ত পাপ মোচন করে দেবেন। হোক না তা সমুদ্রের ফেনা, পৃথিবীর তাবৎ বালি-কণা, বৃক্ষরাজির পত্রসংখ্যা ও পর্বতমালার ওজন পরিমাণ। এরপর কেয়ামত দিবসে তার পরিবারের মধ্যে দোজখ অবধারিত হয়ে গিয়েছে এমন সাতশ ব্যক্তির ব্যাপারে তাকে শাফাআতকারী হিসেবে গ্রহণ করা হবে। (৩)
প্রাজ্ঞ ওলামাদের বক্তব্য
ইমাম নববী রা. বলেন: ইহা একটি জঘন্য বেদআত, কঠিনভাবে পরিত্যাজ্য শরিয়ত গর্হিত কাজ। এতে শামিল রয়েছে বহু মুনকার। তাই এ কাজের সংস্লিষ্টতা অবশ্য বর্জনীয়। এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া বাধ্যতামূলক, ও যারা এতে লিপ্ত তাদেরকেও বারণ করা প্রয়োজন। (৪)
ইবনে নাহ্হাস বলেন: ইহা একটি বেদআত, আর এ ব্যাপারে উল্লেখিত হাদিসসমূহ — হাদিস-বিশেষজ্ঞদের ঐক্য মত্য অনুযায়ী — মাওজু-বানোওয়াট।
ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন : সালাতুর রাগায়েবের কোনো ভিত্তি নেই। ইহা বরং বেদআত। তাই এ নামাজ - একাকী হোক বা জামাত বদ্ধ ভাবে - কোনোভাবেই মোস্তাহাব নয়। মুসলিম শরিফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এক বর্ণনায় এসেছে: শুক্রবার রাতকে ইবাদতের উদ্দেশ্যে অথবা শুক্রবার দিনকে রোজার উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। আর এই মর্মে বর্ণিত হাদিসটি ওলামাদের ঐক্যমতে মিথ্যা-বানোয়াট। সালফে সালেহিন ও ইমামদের কেউ উক্ত হাদিসটি উল্লেখ করেন নি।
হাদিসটি কীভাবে তৈরি করা হল ইমাম তারতুসি তার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের এখানে, বায়তুল মাকদেসে, রজব ও শাবান মাসে সালাতুর রাগায়েব বলতে কখনো কিছু ছিল না। এর উন্মেষ ঘটে চার শত আটচল্লিশ সালে। আমাদের এখানে নাবলুস থেকে ইবনুল হামরা নামের এক ব্যক্তি এলেন। তিনি চমৎকার কুরআন তিলাওয়াত করতে পারতেন। তিনি দাঁড়ালেন ও মাসজিদুল আকসায় শাবানের মধ্যরজনীতে নামাজ আদায় করলেন।.. তারতুসি বলেন: বায়তুল মাকদেসে রজবের নামাজের প্রথম শুরু চার শত আশি সালে। এর পূর্বে আমরা তা দেখিয়ো নি, শুনিয়ো নি। ( ৫)
এই নামাজ বিষয়ক হাদিসটি যে জাল তা প্রাজ্ঞ ওলামা ও হাদিস বিশারদদের অনেকেই বলেছেন, তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল : ইবনুল জাওযি, আল হাফেযুল হাদিস ইবনুল খাত্তাব, ও আবু শামাহ। (৬) ইবনুল হাজ ও ইবনে রাজবও এই হাদিসটি বানোওয়াট হওয়ার ব্যাপারে তাগিদ করে বলেছেন। আবু ইসমাঈল আল আনসারি, আবু বকর আস সময়ানি ও আবুল ফজল ইবন নাসের ও অন্যান্যরা একই মন্তব্য করেছেন।
আবু শামাহ বলেছেন, কেবল সাধারণ মানুষের মন রক্ষার্থে ও মসজিদ ধরে রাখার সার্থে এ নামাজের নেতৃত্ব দেন অনেক ইমাম। কথাটি মসজিদের অনেক ইমামই আমাকে বলেছেন। বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীতই যে তারা নামাজে প্রবেশ করতেন ইমামদের স্বীকারোক্তি থেকে এটাও স্পষ্টভাবে প্রমাণ হচ্ছে। আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোটাকেও যে তারা কত হালকা ভাবে নিয়েছে তার প্রমাণ হিসেবে এসেছে ইমামদের এই স্বীকারোক্তি। উল্লিখিত নামাজ বেদআত হওয়ার জন্য এর থেকে আর বেশি কিছুর দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। যারা এই নামজকে মেনে নিয়েছে অথবা তা উত্তম বলে জ্ঞান করেছে, এই বেদআত প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পথে নিশ্চয়ই তাদের ভূমিকা রয়েছে। জনসাধারণের অযাচিত বিশ্বাসকে তারা প্রাণস্পন্দন দিয়েছে। শরিয়ত বিষয়ে তারা মিথ্যা ক্রিড়ায় লিপ্ত হয়েছে। তারা যদি জনগণকে এ মর্মে বোঝাত, বছরের পর বছর বিষয়টি নিয়ে কথা বলত, জনগণ নিঃসন্দেহে এই বেদআত থেকে ফিরে আসত। তবে বেদআত জিন্দাকারী ও পালকারীদের নেতৃত্ব খর্ব হত, এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
নেতৃত্ব চলে যাওয়ার ভয় আহলে কিতাবদের নেতাদের ইসলাম গ্রহণের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াত। পবিত্র কুরআনে এদের কথা উল্লেখ করেই বলা হয়েছে:
(فَوَيْلٌ لِّلَّذِينَ يَكْتُبُونَ الكِتَابَ بِأَيْدِيهِمْ ثُمَّ يَقُولُونَ هَذَا مِنْ عِندِ اللَّهِ لِيَشْتَرُوا بِهِ ثَمَناً قَلِيلاًً فَوَيْلٌ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ وَوَيْلٌ لَّهُم مِّمَّا يَكْسِبُونَ) [البقرة: 79]
ইসরা ও মেরাজ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহান অলৌকিক ঘটনাসমূহের একটি হল, মসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসায় রাতের বেলায় ভ্রমণ করানো ও সেখান থেকে সপ্তাকাশ ও তার ঊর্ধ্বে ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া।
মে রাজের রাত ২৭ রজব বলে কোনো কোনো দেশে যে রেওয়াজ পড়ে গেছে তা আদৌ ঠিক নয়। ইবনে হাজার ইবনে দাহিয়া থেকে বর্ণনা করে বলেন, কাহিনিকারদের কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন মে রাজ রজব মাসে। তিনি বলেন, এটা মিথ্যা ( ৪) ইবনে রজব বলেন, এমন এক বর্ণনা সূত্রে তা উল্লেখ করা হয়েছে যা অশুদ্ধ। কাসেম ইবনে মুহাম্মদ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইসরা-মে রাজ ছিল রজবের ২৭ তারিখ। ইব্রাহীম হারবি ও অন্যান্যরা এ কথা অস্বীকার করেছেন। (৬)
ইবনে তাইমিয়া বলেন, ইসরা-মে রাজ কোন মাসে, কোন দশকে ও সুনির্দিষ্ট কোন তারিখে হয়েছিল এ বিষয়ে আমাদের জানা মতে কোনো প্রমাণ নেই। এমর্মে যা উল্লেখ হয়েছে তা কর্তিত ও বিভক্ত। অকাট্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব এই ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।(৭)
যদি ইসরা ও মে রাজ সংঘটিত হওয়ার তারিখ সুনির্ধারিতভাবে জানাও থাকে তাহলেও তারিখটি উদযাপন করার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। কারণ সাহাবা ও তাবিইনগণ ইসরা-মে রাজের রাতকে অন্য রাতগুলো থেকে আলাদাভাবে দেখেছেন বলে কোনো দলিল আমাদের হাতে নেই। এ রাত উপলক্ষে অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা তো অনেক দূরের কথা। বরং এ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান বহু বেদআত ও শরিয়ত বিরুদ্ধ কাজকে শামিল করে।(১৮)
রজব মাসে পশু জবাই করা
আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু জবাই করা রজব অথবা রজবের বাইরে নিষিদ্ধ নয়। তবে জাহিলি যুগে রজব মাসে পশু জবাই করার আচারের উপস্থিতি ছিল বলে প্রমাণ মেলে। আচারটি আল আতিরা বলে খ্যাত ছিল।
এই আচার সম্পর্কে ওলামাগণ মতানৈক্য করেছেন। ইসলাম এ আচার রহিত করে দিয়েছে বলে অধিকাংশ ওলামা মন্তব্য করেছেন। বুখারি ও মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিস, এ মন্তব্যের পক্ষে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয়। হাদিসটি হল لا فرع ولا عتيرة ইসলামে ফারা এবং আতিরার কোনো স্থান নেই। (১৯)
ওলামাদের কেউ কেউ, যেমন ইবনে সিরিন, বিষয়টি ভালো মনে করতেন। বৈধতার প্রমাণ হিসেবে কিছু হাদিস তারা উল্লেখ করেছেন। তাদের জবাবে বলা হয়েছে যে আবু হুরাইরা রা. এর হাদিসটি ঐ হাদিসগুলো থেকে বিশুদ্ধ ও সু প্রমাণিত। তাই এ হাদিস অনুযায়ী আমল করা কর্তব্য। কেউ কেউ বরং বলছেন, উদাহরণ ইবনে মুনযের, যে এ ব্যাপারে অন্য হাদিসগুলো মনসুখ, কেননা আবু হুরাইরা রা. পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। আর বৈধতার বিষয়টি ইসলামের শুরুতে ছিল। এ মন্তব্যটিই প্রধান্যপ্রাপ্ত। (২)
হাসান বলেন, ইসলামে আতিরা নেই। আতিরা জাহিলি যুগে ছিল। সেকালে লোকেরা রোজা রাখত ও পশু জবাই করত। (২১) ইবনে রজব বলেন, রজব মাসে পশু জবেহ করার অর্থ রজব মাসকে উৎসব ও ঈদে পরিণত করা। যেমন মিষ্টি খাওয়া ইত্যাদি। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রজব মাসে উৎসব পালন বিষয়টি তিনি খারাপ মনে করতেন। (২২)
রজব মাসে রোজা অথবা ইতিকাফ করা
ইবনে রজব বলেন, বিশেষভাবে রজব মাসে রোজা রাখার ফজিলতের ব্যাপারে কোনো হাদিস উল্লেখ হয় নি। সাহাবা কেরাম থেকেও এই মর্মে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। (২৩)
ইমাম ইবনে তাই মিয়া বলেন, বিশেষভাবে রজবের রোজা পালন বিষয়ক সকল হাদিস দুর্বল, বরং বানোয়াট। প্রাজ্ঞ ওলামাগণ এর কোনোটিকেই প্রমাণ হিসেবে মানেন না। ফজিলতের ব্যাপারে যেসব হাদিস দলিল হিসেবে ব্যবহার করা চলে সে শ্রেণির মধ্যেও হাদিসগুলো পড়ে না। বরং সাধারণভাবে হাদিসগুলো মিথ্যা ও মওজু। ইবনে মাজা তার সুনান গ্রন্থে — রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রজব মাসে রোজা রাখতে বারণ করেছেন। এই হাদিসটি উল্লেখ করেন। তবে এই হাদিসটির সনদ বিষয়ে কথা আছে। হাঁ, ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বিশুদ্ধ বর্ণনানুক্রমে এসেছে যে তিনি রজব মাসের দিনের বেলায় খাবার গ্রহণ করতে মানুষদেরকে বাধ্য করতেন, ও বলতেন, রজবকে রমজানের সাদৃশ্য বানিও না । রজব মাসকে শাবান-রমজানসহ ইতি কাফের জন্য সুনির্দিষ্ট করার পক্ষেও আমাদের জানা মতে কোনো প্রমাণ নেই। তবে শরিয়তের অনুমতি আছে এমন রোজা রাখা হলে, ও এ রোজার ভিত্তিতে ইতি কাফ করলে তা নিঃসন্দেহে বৈধ হবে। আর যদি রোজা ব্যতীত শুধুই ইতি কাফ করা হয় তবে এ ক্ষেত্রে ওলামাদের দুটি মন্তব্য রয়েছে। (২৪)
রজবের সুনির্ধারিত কোনো রোজা নেই এর অর্থ এ নয় যে সাধারণ নফল রোজাও রজবে রাখা যাবে না। উদাহরণ সোমবারের রোজা, বৃহস্পতিবারের রোজা। প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখা। একদিন রোজা রাখা ও একদিন ভঙ্গ করা- এসব নিষেধ নয়। বরং — তারতুসি যেরূপ উল্লেখ করেছেন — রজব মাসে তিন প্রকৃতির রোজা মাকরূহ:
১. সাধারণ মানুষ ও যাদের শরিয়ত সম্পর্কে ধারণা নেই, তাদের সাথে তাল মিলিয়ে রজব মাসের রোজা সুনির্ধারিত করে নেয়া, ঠিক রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার মত।
২. রজবের রোজা অন্যান্য সুন্নতে মুয়াক্কাদার মত প্রতিষ্ঠিত সুন্নত বলে বিশ্বাস করা।
৩. অন্যান্য মাস অপেক্ষা রজবের রোজার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে বলে বিশ্বাস করা। ঠিক যেন আশু রার রোজার মতো। অথবা রাতের প্রথমাংশের তুলনায় শেষাংশে নামাজ পড়ার যে ফজিলত ঠিক সে রকম। এমতাবস্থায়, সুন্নত ফরজ নয় বরং ফজিলতের অধ্যায়ে পড়বে রজবের রোজা। তবে দেখার বিষয় এই যে এরূপ হলেও তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা বলে দিতেন অথবা জীবনে একবার হলেও তিনি তা করতেন। কিন্তু তিনি যেহেতু করেন নি, এর দ্বারা বুঝা গেল এ বিষয়টি কোনো ফজিলতপূর্ণ বিষয় নয়।
রজব মাসে উমরা
রজব মাসে উমরা পালনে খুবই যত্নবান এমন অনেকেই আছেন।রজবের ওমরার আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে বলে তাদের বিশ্বাস। এ ধারণা অমূলক, ভিত্তিহীন। ইমাম বুখারি ইবনে উমর হতে বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার বার ওমরা করেছেন। এবং তার একটি ছিল রজব মাসে। আয়েশা রা. বলেন আবু আব্দুর রাহমানের প্রতি আল্লাহ রহম করুন। রাসূলুল্লাহ এর সকল ওমারাতেই উমর রা. উপস্থিত ছিলেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো রজব মাসে ওমরা করেন নি। (২৬)
ইবনুল আত্তার বলেন, রজব মাসে বেশি বেশি ওমরা পালন সম্পর্কে যে একটি কথা আছে তার কোনো ভিত্তি নেই। (২৭) আল্লামা ইবনে বায বলেন (২৮) উমরা আদায়ের সর্বোত্তম সময় রমজান, হাদিসে এসেছে : রমজানে উমরা হজের সমান। এর পর যিলকদ মাসের উমরা; কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সকল উমরাই ছিল যিলকদ মাসে। পবিত্র কুরআনে এসেছে :
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ. (الأحزاب: 21)
রাসূলুল্লাহর জীবনীতে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে। ( সূরা আহযাব: ২১)
কোনো কোনো দেশে রজব মাসকে যাকাত আদায়ের মাস হিসেবে গণ্য করা হয়। ইবনে রজব বলেন, সুন্নতে এর কোনো ভিত্তি নেই। সালফে সালেহীনদের কারো থেকে এ মর্মে কিছু বর্ণিত হয় নি। তবে মূল কথা হল, যখন নিসাব পরিমাণ সম্পদ কারও কাছে থাকে তাকে অবশ্যই বছর ঘুরে এলে জাকাত প্রদান করতে হবে, করা ফরজ।
রজবে বড় কোনো ঘটনা নেই
ইবনে রজব বলেন, রজব মাসে বড় বড় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে যে কথা আছে, তা শুদ্ধ নয়। বর্ণনা করা হয়েছে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রজবের প্রথম রাতে জন্মগ্রহণ করেছেন, ও রজবের ২৭ তারিখ, বর্ণনান্তরে ২৫ তারিখ নবুয়ত প্রাপ্ত হয়েছেন। এ বর্ণনাগুলোর কোনোটিই শুদ্ধ নয়। ( ৩১)
কিছু দায়ী যা করেন
মৌসুমি কিছু বেদআতে কিছু কিছু দায়ীকে আরোপিত হতে দেখা যায়। উদাহরণ রজবের বেদআত। এগুলোতে তারা আরোপিত হচ্ছে শরিয়ত বিরুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে শত ভাগ নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও। এ বেদআত পরিত্যাগ করলে সাধারণ মানুষ ইবাদত ভিন্ন অন্যসব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়বে, এটাই তাদের যুক্তি।
বেদআত শিরকের পরেই মারাত্মক পাপ বলে বিবেচিত। সে হিসেবে ইসলাম ধরে রাখা বা প্রচারের জন্য এ ধরনের যুক্তি আদৌ মেনে নেয়া যায় না। প্রচারকদের কর্তব্য হল, যা সুন্নত ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ সমর্থিত কেবল তাই প্রচার করা। সাউরি বলেন : ইসলামি আইনবিদগণ বলতেন, প্রয়োগ ব্যতীত কেবল কথার কোনো মূল্য নেই। আর শুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত কথা ও কাজ কোনোটারই কোনো মূল্য নেই। আর কথা-কাজ-নিয়ত সুন্নত অনুযায়ী না হলে এগুলোরও কোনো মূল্য নেই। (৩২)
সুন্নত বিষয়ে যথার্থ জ্ঞান লাভ করা তাদের দায়িত্ব ছিল। নিজেদের এবং তাদের পাশে যারা রয়েছে তাদেরকে সুন্নত বাস্তবায়নের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা তাদের দায়িত্ব ছিল। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, [আমার অনুমোদন নেই এমন কাজ যে করল তা হবে অগ্রহনযোগ্য] আবুল আলিয়া তার সাথিদেরকে খুব চমৎকার বলেছেন: তোমরা ইসলাম শেখো, শেখা হলে তা থেকে কখনো বিচ্যুত হয়ো না। সরল পথ ধরে রাখো। মূলত ইসলামই হল সরল পথ। সরল পথ থেকে ডানে বামে বিচ্যুত হয়ো না। তোমাদের নবীর সুন্নত আকড়ে ধরো। আর দূরে থাকো এ সব প্রবৃত্তি থেকে যা পরস্পরে ঘৃণা ও শত্রুতার উদ্রেক করে। (৩৩)
এর পূর্বে হুযায়ফা রা. বলেছেন : হে কুরআন ওয়ালারা! সরল পথে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়াও। তোমরা বহু অগ্রনী। তোমরা যদি ডানের-বামের পথ ধর তবে বিচ্যুত হবে। (৩৪)
বর্তমান বিশ্বে ইসলাম প্রচারকগণ ও সাথে সাথে উম্মতের সকল সদস্যই, সকল বিষয়ে, কেবল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের অনুসরণ করবে, এটাই ইসলামের দাবি। ইখলাস যেভাবে আল্লাহর জন্য সুনির্ধারিত করতে হয় ঠিক সেই রূপে। নিজেদের পরিত্রাণ, ও তাদের ধর্মের সম্মান-মর্যাদার সমুন্নত রাখার ইচ্ছা হলে এতদ্ভিন্ন অন্য কোনো পন্থা নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন: যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎকাজ করে এবং তার প্রভুর ইবাদতে কাউকে শরিক না করে। [ সূরা আল কাহফ: ১১০] আল্লাহ আরো বলেন : আল্লাহ অবশ্যই সাহায্য করবেন যে আল্লাহকে সাহায্য করে, নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিধর ও অতি ক্ষমতাবান।
ওয়েব গ্রন্থনা : আবুল কালাম আযাদ আনোয়ার /সার্বিক যত্ন : আবহাছ এডুকেশনাল এন্ড রিসার্চ সোসাইটি, বাংলাদেশ।
বিস্তারিত পড়ুনঃ
be Organized by Holy Islam
O.H.I