Monday, June 18, 2012

ইসরা ও মি‘রাজের ফলাফল ও আমাদের করণীয়


السلام عليكم

দৈনন্দিন পথনির্দেশিকা


ইসরা ও মিরাজের ফলাফল ও আমাদের করণীয়


ইসরা ও মিরাজ পরিচিতি:
ইসরা শব্দটির অর্থ রাতের সফর। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাতের একাংশে মক্কার হারাম থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস এর এলাকায় যে সফর করানো হয়েছে সেটাকে ইসরা বলা হয়।
আর মিরাজ হচ্ছেউপরে আরোহন। আল্লাহ তাঁর হাবীব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভূমি থেকে আকাশে আরোহণ করিয়ে প্রথম আকাশ থেকে শুরু করে সপ্তাকাশ ভেদ করে সিদরাতুল মুন্তাহা পেরিয়ে তাঁর নিজের কাছে ডেকে নিয়েছিলেন। সেটাকেই মিরাজ বলা হয়।
ইসরা ও মিরাজের দলীল:
ইসরার দলীল পবিত্র কুরআনের সূরা আল-ইসরা বা বনী ইসরাঈল এর ১ম আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে,
পবিত্র ও মহান সে সত্ত্বা যিনি তাঁর বান্দাকে সফর করিয়েছেন রাতের একাংশে মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসার দিকেযার চতুস্পার্শকে তিনি করেছেন বরকতময়। যাতে তিনি তাকে দেখাতে পারেন তাঁর নিদর্শনসমূহ। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা। [আল-ইসরা:১]
আর মিরাজের দলীল হচ্ছেঅন্য আয়াত যেখানে বলা হয়েছে,
তাছাড়া হাদীসে এসেছেবুখারীতে সাতটি বর্ণনা এবং মুসলিমে ছয়টি বর্ণনা ছাড়াও বহু হাদীসগ্রন্থে এটি এসেছে।
ইসরা ও মিরাজের পটভূমি:
নবুওয়তের দশম বৎসরে একের পর এক বিপদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘিরে ধরে। রাসূলের চাচা আবু তালেব মারা যানযিনি কাফের হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সার্বক্ষনিক নিজের তত্ত্বাবধানে রাখতেন। তার জীবদ্দশায় কেউ তার কোন ক্ষতি করতে চাইলেও সক্ষম হত না। কিন্তু তার মৃত্যুর পর কাফেররা অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে উঠে।
এর কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহাও মারা যান। যিনি শুধু রাসূলের স্ত্রীই ছিলেন নাবরং তার দাওয়াতের প্রধান সহযোগীও ছিলেন। তার সমস্ত সম্পত্তি রাসূলের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তার উপর প্রথম ঈমান এনেছিলেন। এ পথে যত কষ্ট হয়েছে সবই সহ্য করেছেন।
তাদের মৃত্যুর পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসহায় বোধ করলেন। তিনি বিভিন্ন গোত্রপতিদের কাছে নিজেকে পেশ করে বললেনকে আমাকে আশ্রয় দিবে যাতে আমি আমার রবের কথা প্রচার করতে পারি? কিন্তু কেউ তার ডাকে সাড়া দিল না।
এমতাবস্থায় তিনি তায়েফ গেলেন। সেখানে তায়েফের সর্দারদের কাছে তিনি একই কথা ব্যক্ত করলেন। তাদের কেউ তার কথায় কর্ণপাতই করল না। উপরন্তু তারা দুষ্ট শিশুদের তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল। এমতাবস্থায় যা ঘটার তা-ই ঘটল। তারা তাকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করে দিল।
তিনি মক্কায় ফিরে আসলেন। মহান আল্লাহ্ তাকে সম্মানিত করতে চাইলেন। তিনি তাকে ইসরা ও মিরাজের মত বিরল সম্মানে সম্মানিত করলেন।
ইসরা ও মিরাজের সংক্ষিপ্ত কাহিনী
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবা শরীফের হিজ্‌র বা হাতীমে শোয়া ছিলেন। তার সাথে আরও দুজন শোয়া ছিলেন। কোন কোন বর্ণনায় তাদের নাম এসেছেহামযাহ ও জাফর। এমতাবস্থায় তিন ফেরেশতা এসে বললেনএদের মধ্যে কোনটি সে লোকএকজন বললমাঝখানে যিনি শুয়ে আছেন তিনি। তারপর তারা চলে গেলেন।
পরবর্তী দিন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের সালাত আদায় করে নিজ ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। এমতাবস্থায় ঘরের ছাদ ভেদ করে ফেরেশতাগণ অবতরণ করলেন। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যমযমের কাছে নিয়ে গেলেন। তারপর তার সাক্কুস সাদর বা বক্ষ বিদীর্ণ করলেন। তারপর তাকে যমযমের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে লাগিয়ে দিয়ে বক্ষ মিলিয়ে দিলেন।
এরপর বুখারীর বর্ণনায় এসেছেরাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে আকাশের দিকে যাত্রা করা হয়। সেখানে প্রথম আকাশে আদমদ্বিতীয় আকাশে ঈসা ও ইয়াহইয়াতৃতীয় আকাশে ইউসুফচতুর্থ আকাশে ইদরীসপঞ্চম আকাশে হারূনষষ্ট আকাশে মূসা এবং সপ্তম আকাশে ইবরাহীম আলাইহিমুস সালাম এর সাথে সাক্ষাত করেন। সেখানে তিনি বাইতুল মামুর দেখতে পেলেন। সেখানে তাকে দুধমধু ও মদ এ তিনপ্রকার পানীয় দেয়া হয়। তিনি দুধ পছন্দ করে নেন। তখন জিবরীল বললেন যেআপনি স্বাভাবিক বিষয় গ্রহণ করতে সমর্থ হলেন। তারপর তিনি সিদরাতুল মুন্তাহায় নীত হলেন। তারপর এত উচুতে গেলেন যেকলমের লিখার খসখস আওয়াজ শুনতে পেলেন। এরপর আল্লাহ্ তার ও তার উম্মতের উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরয করে দিলেন। এরপর মুসা আলাইহিস সালাম এর কাছে আসার পর তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সালাতের ব্যাপারে আল্লাহ্‌র কাছে কমানোর আবেদন করার পরামর্শ দিলেন। প্রথমে অর্ধেকতারপর পাঁচ ওয়াক্ত পর্যন্ত কমানো হয়। অপর বর্ণনায়প্রতিবারে পাঁচবর্ণনান্তরে দশ করে কমানোর পর সবশেষে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে এসে তা শেষ হয়। এরপর তিনি দুনিয়াতে ফেরত আসেন।
অন্য বর্ণনায় এসেছে যেসফরের শুরুতে বোরাক নিয়ে আসা হয়। বোরাক বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে সফর করে। সেখানে তিনি নবীদের ইমামতি করেন। তারপর তাকে সেখানে তাকে দুধ মধু ও মদ এ তিনপ্রকার পানীয় দেয়া হয়।   তিনি দুধ পছন্দ করে নেন। তখন জিবরীল বললেন যেআপনি স্বাভাবিক বিষয় গ্রহণ করতে সমর্থ হলেন। তারপর তার জন্য মিরাজ বা সিড়ি নামিয়ে দেয়া হলে তিনি তাতে করে আকাশে গমন করলেন।...
ইসরা ও মিরাজের ফলাফল:
১- ইসরা ও মিরাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ তার রাসূলকে বান্দা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এটি সৃষ্টিজগতের কারও জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া। মহান আল্লাহ্ বলেন,
﴿سُبۡحَٰنَ ٱلَّذِيٓ أَسۡرَىٰ بِعَبۡدِهِۦ لَيۡلٗا مِّنَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ إِلَى ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡأَقۡصَا ٱلَّذِي بَٰرَكۡنَا حَوۡلَهُۥ لِنُرِيَهُۥ مِنۡ ءَايَٰتِنَآۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١﴾ [سورة بني إسرائيل: 1 ]
২- ইসরা ও মিরাজের মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়েছে যেনবীগণ সবাই বৈমাত্রেয় ভাই। তাদের মিশন একটিই সেটি হলোএকমাত্র আল্লাহ্‌র ইবাদত প্রতিষ্ঠা করা।
৩- রাতের একটি অংশে ইসরা ও মিরাজ সংঘটিত হওয়ার মধ্যে এটাই উদ্দেশ্য যেমহান আল্লাহ্র কাছে রাতের কাজই বেশী পছন্দ। কারণ তখন প্রকৃতি শান্ত থাকে। কাজে মন বসে। ইবাদতে একনিষ্ঠতা ও একাগ্রতা অর্জিত হয়।
৪- সূরা আল-ইসরার প্রথমে سُبۡحَٰنَ ٱلَّذِيٓ أَسۡرَى বলার পরে নবম আয়াতে কুরআনের মাধ্যমে কারা হিদায়াত প্রাপ্ত হবে তাদের কথা আলোচনা করা হয়েছে। এ দুয়ের মাঝখানে ইয়াহূদীদের উপর আপতিত শাস্তি ও তাদের জাতীয় চরিত্রের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এটাই বোঝানো হয়েছে যেইয়াহূদী ও নাসারাদের দীনের দাবী শেষ হয়ে গেছে এখন কুরআনের দিন এসেছে।
৫- ইসরা ও মিরাজে নবীদের ইমামতির মাধ্যমে এ বিষয় প্রমাণিত হলো যেসমস্ত নবীর নবুওয়তের মাধ্যমে প্রাপ্ত শরীআত শেষ হয়েছে। এখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়ত ও তারই শরীয়ত চলবে। আর তার শরীয়তই সর্বশেষ শরীআত। তিনিই শেষ নবী ও রাসুল।
৬- দুই কেবলার ইমামতি ও নেতৃত্ব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার উম্মতদের জন্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। এ দুটির মালিকানা তাদেরই।
৭- এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যেদুনিয়ার মানুষ আপনাকে সম্মান করতে কমতি করলেও আকাশে যারা আছে তারা আপনাকে সবচেয়ে বেশী সম্মানিত করে গ্রহণ করে নিচ্ছে। দুনিয়াতে মানুষের কর্মকাণ্ডে আপনি দুঃখিত হলেও আকাশে আপনাকে সাদর সম্ভাষণ জানানোর জন্য অনেকেই রয়েছেন। সর্বোপরি মহান আল্লাহ্ আপনাকে ছেড়ে যাবেন না।
৮- সালাত এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রুকন যার ফরয হওয়ার ঘোষণা কোন মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন। আর যা দুনিয়াতে ফরয না করে আকাশে প্রিয় নবীকে ডেকে এনে জানিয়ে দিয়েছেন। এটা যেন উম্মতের জন্য এক হাদীয়া। সে হাদীয়া যেন মাটিতে দেয়া যেত নাআকাশেই দিতে হবে।
৯- এর ফলে হিজরতের পথ প্রসারিত হলোএর মাধ্যমে জানানো হলো যেমূসা আলাইহিস সালামের উম্মতের চেয়েও তার উম্মত বেশী হবে। ফলে এর মাধ্যমে দাওয়াতের নতুন ক্ষেত্র আবিস্কৃত হবে এটাই বোঝা গেল।
১০- কারও রক্তচক্ষুর ভয় না করে হকের কথা বলতে সদা সচেষ্ট থাকা। যেমন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেরাজের কথা সবাইকে জানিয়েছিলেন। সুতরাং বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাও এর লক্ষ্য ছিল।
১১- কারা ঈমানদার ও কারা বেঈমান বা দুর্বল ইমানের অধিকারী সেটা পরিস্কার হয়ে যাওয়া। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَمَا جَعَلۡنَا ٱلرُّءۡيَا ٱلَّتِيٓ أَرَيۡنَٰكَ إِلَّا فِتۡنَةٗ لِّلنَّاسِ [سورة بني إسرائيل: 60]
অর্থাৎ আর আমরা আপনাকে যে দৃশ্য দেখিয়েছিলামতা তো কেবল মানুষকে পরীক্ষা করার জন্যই। [সূরা আল-ইসরা: ৬০]
কারণরাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নতুন মিশনে যাচ্ছেন। সেখানে পাক্কা ইমানদারদের প্রয়োজন হবে।
১২- আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঈমানের দৃঢ়তা এখানে প্রকাশ পেল। তিনি নির্দ্বিধায় সেটার উপর ঈমান এনেছিলেন।
১৩- বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি কেমন হতে পারে সেটার এক নির্দেশনা পেলে মানুষের পক্ষে দ্বীন ও ঈমানের উপর মজবুতি আসবে।
১৪- দুধ পান করা ও মদ থেকে দুরে থাকার মাধ্যমে ইসলাম যে স্বাভাবিক দ্বীন সেটা প্রমানিত হলো।
১৫- মাসজিদুল আকসা সমস্ত মুসলিমের সম্পদ। যেখানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাত আদায় করেছেন। ইমামতি করেছেন। আকাশে আরোহন করেছেন। সেখানে গেলে সওয়াব হওয়া কথা ঘোষণা করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যেবাইতুল মুকাদ্দাসের মুক্তির সাথেই মুসলিম উম্মাহর সম্মান ও প্রতিপত্তি নিহিত।
আমাদের করণীয়:
১- ঈমান বিল গায়েব। আবু বকরের মত ঈমানদার হওয়া। ইসরা ও মিরাজের প্রমাণিত কোন কিছুকে অস্বীকার না করা। করলে কুফরী হবে।
২- সালাতের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া। কারণএ সালাত আকাশে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ডেকে সম্মানের সাথে প্রদান করা হয়েছে। দুনিয়ার কোন স্থানে বা অন্য কোন মাধ্যমে সেটা ফরয করা হয়নি।
৩- মিরাজের রাত্রিতে পবিত্র কুরআনের সূরা আল-বাকারার শেষ দুটি আয়াতও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রদান করা হয়েছে। সে দুটি আয়াত পাঠ করা এবং বাস্তব জীবনে সেগুলোর প্রচার ও প্রসার করা প্রয়োজন।
৪- বাইতুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট থাকা।
যা করণীয় নয়:
১- যেহেতু এ রাত্রি নির্ধারনের ব্যাপারে সহীহ কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নিসেহেতু তা নির্ধারণ থেকে বিরত থাকা।
২- শুধুমাত্র এ রাত্রিকে নির্ধারণ করে বা কেন্দ্র করে কোনো প্রকার ইবাদত করা।
৩- শুধুমাত্র এ রাত্রে বা এ দিনকে কেন্দ্র করে কোন সালাত বা সাওম রাখা।
 


লেখক : আবু বকর মুহাম্মদ যাকারিয়া
http://www.sorolpath.com/


be 
Organized by Holy Islam 

O.H.I