Sunday, April 22, 2012

মানব ও সমাজসেবায় ইসলামের প্রেরণা-১


السلام عليكم

মানব ও সমাজসেবায় ইসলামের প্রেরণা-১

 

‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি এ জীবন মন সকলি দাও
তার মত সুখ কোথাও কি আছে আপনার কথা ভুলিয়া যাও।’
অন্যের ব্যথায় সমব্যথী হওয়া এবং পরের বিপদে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা একটি মহৎ গুণ। এক ধরনের নেকীর কাজ। হিতৈষী মনোভাব ও সহমর্মিতার গুণ ছাড়া মানবিকতা ও মহানুভবতার বিকাশ পূর্ণতা পায় না।
আমি তিনবেলা পেট পুরে খেতে পারি। একাধিক পদের তরকারি ছাড়া আমার খাবার রোচে না। বিচিত্র স্বাদ আস্বাদন ছাড়া আমার রসনা তৃপ্ত হয় না। বাসার নৈশ প্রহরী কুকুরকে নিত্য টাটকা গোশত খাওয়াই। দুই বেলা শাহী খাবার খেতে দেই। শ্যাম্পু ছাড়া ওর গোসল হয় না। অথচ পাশের বস্তিতে খাবার না পেয়ে অবোধ শিশুরা চিৎকার করে কাঁদে। জঠরজ্বালা সইতে না পেরে কত বনী আদম পথের ধারে উপুড় হয়ে কাতরায়। ফল-ফ্রুটস খেতে খেতে আমার আদরের দুলালের অরুচি ধরে যায়। অথচ বাড়ির বুয়ার অভুক্ত সন্তানদের মুখে মৌসুমী ফলটি পর্যন্ত ওঠে না। ক্ষুদে মাছির লঘু পদভার পড়ামাত্র সুডৌল আপেল, রসে টইটুম্বর আঙ্গুর ও টসটসে কমলা ওরা প্রায়শই নিক্ষেপ করে ডাস্টবিনে। অথচ এরা পঁচা ও উচ্ছিষ্ট ফল খাওয়ার জন্য ইতর প্রাণীর সঙ্গে যুদ্ধ করে ডাস্টবিনে। ফ্যাশন বদলের সঙ্গে সঙ্গেই আমার মেয়ের শীতবস্ত্র আর গ্রীষ্মের পোশাক বদল হয়। অথচ অদূরের গাঁয়েই কি-না শীতবস্ত্রের অভাবে গরীবের প্রাণ যায়।
এসব তো বিবেক বা মানবতার পরিচায়ক নয়। অমানবের চেয়ে মানব শ্রেষ্ঠ কেন? প্রাণের কারণে? কেবল বুদ্ধির কারণে? মোটেও না। প্রাণের বৈশিষ্ট্যে মানুষ ও জীব-জন্তু প্রায় অভিন্ন। মানুষ বুদ্ধিমান জীব বলে অন্য সব জীবজন্তু একেবারে বুদ্ধিহীন নয়। বরং বুদ্ধির সঙ্গে বিবেক এবং আপন চাহিদার সঙ্গে মানবিকতার সংশ্লেষই অন্য সব জীব-জন্তুর ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এনে দিয়েছে। ইসলাম এ কারণে মানব সমাজে এমন বৈষম্য ও প্রভেদের কোনো সুযোগ রাখে নি। ইসলাম মানুষকে সর্বোচ্চ মানবিকতা, পরহিতৈষণা, সহমর্মিতা ও মহানুভবতার শিক্ষা দিয়েছে। এ উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাঁর নবীকে প্রেরণ দয়া ও সহমর্মিতার প্রতীক হিসেবে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا رَحۡمَةٗ لِّلۡعَٰلَمِينَ ١٠٧﴾ [الأنبياء: ١٠٧]
‘আর আমি আপনাকে সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।’ {সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭}
অনাহারীর কষ্টের ভাগিদার হতে এবং জনমদুখী বান্দার দুঃখে সমব্যথী হতে আল্লাহ তা‘আলা রমযানের সিয়াম ফরয করেছেন। দুঃখীর অভাব মোচনে যাকাত ফরয ও সাদাকুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন। একই উদ্দেশে সালাত, সিয়াম ইত্যাদির ফিদইয়া ও লে‘আনের বিধান এবং কসম ইত্যাদির কাফফার বিধান প্রবর্তন করেছেন। দান-সদকা ও অন্যের জন্য খরচে উদ্বুদ্ধ করে অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে। যেমন :
ক. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَّن ذَا ٱلَّذِي يُقۡرِضُ ٱللَّهَ قَرۡضًا حَسَنٗا فَيُضَٰعِفَهُۥ لَهُۥ وَلَهُۥٓ أَجۡرٞ كَرِيمٞ ١١﴾ [الحديد: ١١]
‘এমন কে আছে যেআল্লাহকে উত্তম করয দেবেতাহলে তিনি তার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেবেন এবং তার জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান।’ {সূরা আল-হাদীদ, আয়াত : ১১}
খ. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَّن ذَا ٱلَّذِي يُقۡرِضُ ٱللَّهَ قَرۡضًا حَسَنٗا فَيُضَٰعِفَهُۥ لَهُۥٓ أَضۡعَافٗا كَثِيرَةٗۚ وَٱللَّهُ يَقۡبِضُ وَيَبۡصُۜطُ وَإِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ٢٤٥﴾ [البقرة: ٢٤٥]
‘কে আছেযে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেবেফলে তিনি তার জন্য বহু গুণে বাড়িয়ে দেবেনআর আল্লাহ সংকীর্ণ করেন ও প্রসারিত করেন এবং তাঁরই নিকট তোমাদেরকে ফিরানো হবে।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ২৬১}
গ. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَّثَلُ ٱلَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمۡوَٰلَهُمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنۢبَتَتۡ سَبۡعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنۢبُلَةٖ مِّاْئَةُ حَبَّةٖۗ وَٱللَّهُ يُضَٰعِفُ لِمَن يَشَآءُۚ وَٱللَّهُ وَٰسِعٌ عَلِيمٌ ٢٦١﴾ [البقرة: ٢٦١]   
‘যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করেতাদের উপমা একটি বীজের মতযা উৎপন্ন করল সাতটি শীষপ্রতিটি শীষে রয়েছে একশ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়সর্বজ্ঞ।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ২৬১}
ঘ. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ ٱلۡمُصَّدِّقِينَ وَٱلۡمُصَّدِّقَٰتِ وَأَقۡرَضُواْ ٱللَّهَ قَرۡضًا حَسَنٗا يُضَٰعَفُ لَهُمۡ وَلَهُمۡ أَجۡرٞ كَرِيمٞ ١٨﴾ [الحديد: ١٨]
‘নিশ্চয় দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী এবং যারা আল্লাহকে উত্তম করয দেয়তাদের জন্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়া হবে এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান।’ {সূরা আল-হাদীদ, আয়াত : ১৮}
ঙ. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ مَا ٱسۡتَطَعۡتُمۡ وَٱسۡمَعُواْ وَأَطِيعُواْ وَأَنفِقُواْ خَيۡرٗا لِّأَنفُسِكُمۡۗ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفۡسِهِۦ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ١٦ إِن تُقۡرِضُواْ ٱللَّهَ قَرۡضًا حَسَنٗا يُضَٰعِفۡهُ لَكُمۡ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡۚ وَٱللَّهُ شَكُورٌ حَلِيمٌ ١٧﴾ [التغابن: ١٦،  ١٧]
‘অতএব তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করশ্রবণ করআনুগত্য কর এবং তোমাদের নিজদের কল্যাণে ব্যয় করআর যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য থেকে রক্ষা করা হয়তারাই মূলত সফলকাম। যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাওতিনি তা তোমাদের জন্য দ্বিগুন করে দিবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহীপরম ধৈর্যশীল।’   {সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত : ১৬-১৭}
চ. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَقۡرِضُواْ ٱللَّهَ قَرۡضًا حَسَنٗاۚ وَمَا تُقَدِّمُواْ لِأَنفُسِكُم مِّنۡ خَيۡرٖ تَجِدُوهُ عِندَ ٱللَّهِ هُوَ خَيۡرٗا وَأَعۡظَمَ أَجۡرٗاۚ وَٱسۡتَغۡفِرُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمُۢ ٢٠﴾ [المزمل: ٢٠]
‘আর সালাত কায়েম করযাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। আর তোমরা নিজদের জন্য মঙ্গলজনক যা কিছু অগ্রে পাঠাবে তোমরা তা আল্লাহর কাছে পাবে প্রতিদান হিসেবে উৎকৃষ্টতর ও মহত্তর রূপে। আর তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীলপরম দয়ালু।’ {সূরা আল-মুযযাম্মিল, আয়াত : ২০}
ছ. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَفِيٓ أَمۡوَٰلِهِمۡ حَقّٞ لِّلسَّآئِلِ وَٱلۡمَحۡرُومِ ١٩ ﴾ [الذاريات: ١٩] 
‘আর তাদের ধনসম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক।’ {সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত : ১৯}
জ. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَٱلَّذِينَ فِيٓ أَمۡوَٰلِهِمۡ حَقّٞ مَّعۡلُومٞ ٢٤ لِّلسَّآئِلِ وَٱلۡمَحۡرُومِ ٢٥ ﴾ [المعارج: ٢٤،  ٢٥] 
‘আর যাদের ধন-সম্পদে রয়েছে নির্ধারিত হকযাচ্ঞাকারী ও বঞ্চিতের’। {সূরা আল-মা‘আরিজ, আয়াত : ২৪-২৫}
এ ধরনের আরো অসংখ্য আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মানবের সেবা ও সমাজের কল্যাণের নির্দেশ ও উৎসাহ দিয়েছেন। তেমনি মানবমুক্তি ও সমাজকল্যাণের মহান প্রতিভূ মুহাম্মদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনভর এ শিক্ষা প্রচার করেছেন। মানবসেবা ও সমাজকল্যাণের চর্চা করেছেন আপন কর্মে যেমন, তেমনি নানা উপলক্ষ্যে নানাভাবে এর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন আপন বাণী বা উক্তিসমগ্রে। কিয়ামত অবধি আগত মানবতার শান্তি ও কল্যাণে তিনি অনাগত সকল ঈমানদারের সামনে এ আদর্শ রেখে গেছেন।
নবুওয়ত লাভের প্রাক্কালে হিলফুল ফুযূল নামক সংস্থা গড়েছিলেন। সেখানে কিছু যুবককে নিয়ে তিনি এ মর্মে অঙ্গিকারাবদ্ধ হন, ‘আমরা নিঃস্ব ও অসহায় দুর্গতদের সেবা করব। অত্যাচারী প্রাণপণে বাধা দেব, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করব এবং বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনে সচেষ্ট হব।’ [বিশ্বনবী পৃ. : ৫৭]
আলী হাসান তৈয়ব
Collected From: http://www.islamhouse.com/