السلام عليكم
স্মরণ করি: রামাদান ম্যানুয়াল-১৮
বিষয়: পিতামাতার
প্রতি ভাল ব্যবহার
সূরা বনী ইসরাইল:
২৩-৪০
وَقَضَى رَبُّكَ
أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ
عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا فَلاَ تَقُل لَّهُمَآ أُفٍّ وَلاَ تَنْهَرْهُمَا
وَقُل لَّهُمَا قَوْلاً كَرِيمًا (২৩) وَاخْفِضْ
لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي
صَغِيرًا (২৪) رَّبُّكُمْ
أَعْلَمُ بِمَا فِي نُفُوسِكُمْ إِن تَكُونُواْ صَالِحِينَ فَإِنَّهُ كَانَ لِلأَوَّابِينَ
غَفُورًا (২৫) وَآتِ ذَا
الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلاَ تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا (২৬)
إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُواْ إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ
وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا (২৭) وَإِمَّا
تُعْرِضَنَّ عَنْهُمُ ابْتِغَاء رَحْمَةٍ مِّن رَّبِّكَ تَرْجُوهَا فَقُل لَّهُمْ قَوْلاً
مَّيْسُورًا (২৮) وَلاَ تَجْعَلْ
يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلاَ تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا
مَّحْسُورًا (২৯) إِنَّ رَبَّكَ
يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَن يَشَاء وَيَقْدِرُ إِنَّهُ كَانَ بِعِبَادِهِ خَبِيرًا بَصِيرًا (৩০)
وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاقٍ
نَّحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُم إنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْءًا كَبِيرًا (৩১)
وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً
وَسَاء سَبِيلاً (৩২) وَلاَ تَقْتُلُواْ
النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلاَّ بِالحَقِّ وَمَن قُتِلَ مَظْلُومًا فَقَدْ
جَعَلْنَا لِوَلِيِّهِ سُلْطَانًا فَلاَ يُسْرِف فِّي الْقَتْلِ إِنَّهُ كَانَ مَنْصُورًا (৩৩)
وَلاَ تَقْرَبُواْ مَالَ الْيَتِيمِ إِلاَّ بِالَّتِي
هِيَ أَحْسَنُ حَتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّهُ وَأَوْفُواْ بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ
كَانَ مَسْؤُولاً (৩৪) وَأَوْفُوا
الْكَيْلَ إِذا كِلْتُمْ وَزِنُواْ بِالقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِيمِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ
تَأْوِيلاً (৩৫) وَلاَ تَقْفُ
مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولئِكَ
كَانَ عَنْهُ مَسْؤُولاً (৩৬) وَلاَ تَمْشِ
فِي الأَرْضِ مَرَحًا إِنَّكَ لَن تَخْرِقَ الأَرْضَ وَلَن تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُولاً (৩৭)
كُلُّ ذَلِكَ كَانَ سَيِّئُهُ عِنْدَ رَبِّكَ
مَكْرُوهًا (৩৮) ذَلِكَ مِمَّا
أَوْحَى إِلَيْكَ رَبُّكَ مِنَ الْحِكْمَةِ وَلاَ تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ
فَتُلْقَى فِي جَهَنَّمَ مَلُومًا مَّدْحُورًا (৩৯) أَفَأَصْفَاكُمْ
رَبُّكُم بِالْبَنِينَ وَاتَّخَذَ مِنَ الْمَلآئِكَةِ إِنَاثًا إِنَّكُمْ لَتَقُولُونَ
قَوْلاً عَظِيمًا (৪০)
২৩) তোমার রব ফয়সালা করে দিয়েছেন
২৫ (১) তোমরা কারোর ইবাদাত করো না, একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করো।২৬ (২) পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করো। যদি
তোমাদের কাছে তাদের কোনো একজন বা উভয় বৃদ্ধ অবস্থায় থাকে, তাহলে তাদেরকে “উহ” পর্যন্তও বলো না এবং তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিয়ো না বরং
তাদের সাথে মর্যাদা সহকারে কথা বলো ২৪) আর
দয়া ও কোমলতা সহকারে তাদের সামনে বিনম্র থাকো এবং দোয়া করতে থাকো এই বলে: হে আমার প্রতিপালক!
তাদের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা দয়া, মায়া, মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।
২৫) তোমাদের রব খুব ভালো করেই
জানেন তোমাদের মনে কি আছে। যদি তোমরা সৎকর্মশীল হয়ে জীবন যাপন করো, তাহলে তিনি এমন লোকদের প্রতি ক্ষমাশীল যারা নিজেদের ভুলের
ব্যাপারে সতর্ক হয়ে বন্দেগীর নীতি অবলম্বন করার দিকে ফিরে আসে।২৭ ২৬) (৩) আত্মীয়কে
তার অধিকার দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকেও তাদের অধিকার দাও।
২৭) (৪) বাজে খরচ করো না।
যারা বাজে খরচ করে তারা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ।
২৮) (৫) যদি তাদের থেকে (অর্থাৎ
অভাবী, আত্মীয়-স্বজন, মিসকীন ও মুসাফির) তোমাকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয় এজন্য যে, এখনো তুমি প্রত্যাশিত রহমতের সন্ধান করে ফিরছো, তাহলে তাদেরকে নরম জবাব দাও।২৮ ২৯) (৬) নিজের হাত গলায় বেঁধে রেখো না এবং
তাকে একেবারে খোলাও ছেড়ে দিয়ো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও অক্ষম
হয়ে যাবে।২৯ ৩০) তোমার রব যার জন্য চান রিযিক প্রশস্ত করে দেন আবার যার জন্য চান সংকীর্ণ
করে দেন। তিনি নিজের বান্দাদের অবস্থা জানেন এবং তাদেরকে দেখছেন।৩০ ৩১) (৭) দারিদ্রের
আশংকায় নিজেদের সন্তান হত্যা করো না। আমি তাদেরকেও রিযিক দেবো এবং তোমাদেরকেও। আসলে
তাদেরকে হত্যা করা একটি মহাপাপ।৩১ ৩২) (৮) যিনার কাছেও যেয়ো না, ওটা অত্যন্ত খারাপ কাজ এবং খুবই জঘন্য পথ।৩২ ৩৩) (৯) আল্লাহ যাকে হত্যা
করা হারাম করে দিয়েছেন,৩৩ সত্য ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করো না।৩৪
আর যে ব্যক্তি মজলুম অবস্থায় নিহত হয়েছে তার অভিভাবককে আমি কিসাস দাবী করার অধিকার
দান করেছি। ৩৫ কাজেই হত্যার ব্যাপারে তার সীমা অতিক্রম করা উচিত নয়,৩৬ তাকে সাহায্য করা হবে।৩৭ ৩৪) (১০) ইয়াতীমের সম্পত্তির ধারে কাছে যেয়ো
না, তবে হ্যাঁ সদুপায়ে, যে পর্যন্তনা
সে বয়োপ্রাপ্ত হয়ে যায়।৩৮ (১১) প্রতিশ্রুতি পালন করো, অবশ্যই
প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে।৩৯ ৩৫) (১২) মেপে দেবার সময় পাত্র
ভরে দাও এবং ওজন করে দেবার সময় সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওজন করো। ৪০ এটিই ভালো পদ্ধতি এবং
পরিণামের দিক দিয়েও এটিই উত্তম।৪১
৩৬) (১৩) এমন কোনো জিনিসের
পেছনে লেগে যেয়ো না যে সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই। নিশ্চিতভাবেই চোখ, কান ও দিল সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।৪২ ৩৭) (১৪) যমীনে
দম্ভভরে চলো না। তুমি না যমীনকে চিরে ফেলতে পারবে, না পাহাড়ের
উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারবে।৪৩ ৩৮) এ বিষয়গুলোর মধ্য থেকে প্রত্যেকটির খারাপ দিক তোমার
রবের কাছে অপছন্দনীয়।৪৪ ৩৯) তোমার রব তোমাকে অহীর মাধ্যমে যে হিকমতের কথাগুলো বলেছেন
এগুলো তার অন্তর্ভুক্ত। আর দেখো, আল্লাহর সাথে অন্য কোনো মাবুদ
স্থির করে নিয়ো না, অন্যথায় তোমাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা
হবে নিন্দিত এবং সব রকমের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত অবস্থায়।৪৫ ৪০) কেমন অদ্ভূত কথা,
তোমাদের রব তোমাদের পুত্র সন্তান দিয়ে অনুগৃহীত করেছেন এবং নিজের
জন্য ফেরেশতাদেরকে কন্যা সন্তান বানিয়ে নিয়েছেন? ৪৬ এটা ভয়ানক
মিথ্যা কথা, যা তোমরা নিজেদের মুখে উচ্চারণ করছো।
আয়াত সমূহের ব্যাখ্যা
২৫. এখানে এমন সব বড় বড় মূলনীতি
পেশ করা হয়েছে যার ওপর ভিত্তি করে ইসলাম মানুষের সমগ্র জীবন ব্যবস্থার ইমারত গড়ে তুলতে
চায়। একে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আন্দোলনের ঘোষণাপত্র বলা যায়। মক্কী
যুগের শেষে এবং আসন্ন মাদানী যুগের প্রারম্ভ লগ্নে এ ঘোষণাপত্র পেশ করা হয়। এভাবে এ
নতুন ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের বুনিয়াদ কোন ধরনের চিন্তামূলক, নৈতিক, তামাদ্দুনিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত মূলনীতির ওপর রাখা হবে তা সারা দুনিয়ার মানুষ জানতে পারবে।
এ প্রসংগে সূরা আনআ’মের ১৯ রুকূ’ এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট টীকার ওপরও একবার চোখ বুলিয়ে নিলে
ভাল হয়।
২৬. এর অর্থ কেবল এতটুকুই
নয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কারো পূজা-উপাসনা করো
না বরং এ সংগে এর অর্থ হচ্ছে, বন্দেগী, গোলামী ও দ্বিধাহীন আনুগত্য একমাত্র আল্লাহরই করতে হবে। একমাত্র তাঁরই হুকুমকে
হুকুম এবং তাঁরই আইনকে আইন বলে মেনে নাও এবং তাঁর ছাড়া আর কারো সার্বভৌম কর্তৃত্ব স্বীকার
করো না। এটি কেবলমাত্র একটি ধর্ম বিশ¡াস এবং ব্যক্তিগত
কর্মধারার জন্য একটি পথনির্দেশনাই নয় বরং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা
তাইয়্যেবায় পৌঁছে কার্যত যে রাজনৈতিক, তামাদ্দুনিক ও নৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেন এটি হচ্ছে সেই সমগ্র ব্যবস্থার
ভিত্তি প্রস্তরও। এ ইমারতের বুনিয়াদ রাখা হয়েছিল এ মতাদর্শের ভিত্তিতে যে, মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহই সমগ্র বিশ¡লোকের মালিক ও বাদশাহ
এবং তাঁরই শরীয়াত এ রাজ্যের আইন।
২৭. এ আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহর পরে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশী হক ও অগ্রাধিকার
হচ্ছে পিতামাতার। সন্তানকে পিতামাতার অনুগত, সেবা পরায়ণ ও
মর্যাদাবোধ সম্পন্ন করতে হবে। সমাজের সামষ্টিক নৈতিক বৃত্তি এমন পর্যায়ের হতে হবে,
যার ফলে সন্তানরা বাপ-মায়ের মুখাপেক্ষীহীন হয়ে পড়বে না, বরং তারা নিজেদেরকে বাপ-মায়ের অনুগৃহীত মনে করবে এবং বুড়ো বয়সে তাদেরকে
ঠিক তেমনিভাবে বাপ-মায়ের খিদমত করা শেখাবে যেমনিভাবে বাপ-মা শিশুকালে তাদের পরিচর্যা
ও লালন পালন এবং মান-অভিমান বরদাশত করে এসেছে। এ আয়াতটিও নিছক একটি নৈতিক সুপারিশ নয়
বরং এরই ভিত্তিতে পরবর্তী পর্যায়ে বাপ-মায়ের জন্য এমনসব শরয়ী অধিকার ও ক্ষমতা নির্ধারণ
করা হয়েছে যেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ আমরা হাদীসে ও ফিকাহর কিতাবগুলোতে পাই। তাছাড়া ইসলামী
সমাজের মানসিক ও নৈতিক প্রশিক্ষণ এবং তাদের অধিকারের রক্ষাণাবেক্ষণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ
উপাদান হিসেবে ও আনুগত্য এবং তাদের অধিকারের রক্ষণাবেক্ষণকে একটি গুরত্বপূর্ণ উপাদান
হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ জিনিসগুলো চিরকালের জন্য এ নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে
যে, ইসলামী রাষ্ট্র নিজের আইন কানুন, ব্যবস্থাপনামূলক বিধান ও শিক্ষানীতির মাধ্যমে পরিবার প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী
ও সংরক্ষিত করার চেষ্টা করবে, দুর্বল করবে না।
২৮. এ তিনটি ধারার উদ্দেশ্য
হচ্ছে, মানুষ নিজের উপার্জন ও ধন-দৌলত শুধুমাত্র
নিজের জন্যই নির্ধারিত করে নেবে না বরং ন্যায়সংগতভাবে ও ভারসাম্য সহকারে নিজের প্রয়োজন
পূর্ণ করার পর নিজের আত্মীয়-স্বজন ও অন্যান্য অভাবী লোকদের অধিকার আদায় করবে। সমাজ
জীবনে সাহায্য-সহযোগিতা, সহানুভূতি এবং অন্যের অধিকার জানা
ও তা আদায় করার প্রবণতা সক্রিয় ও সঞ্চারিত থাকবে। প্রত্যেক আত্মীয় অন্য আত্মীয়ের সাহায্যকারী
এবং প্রত্যেক সামর্থবান ব্যক্তি নিজের আশপাশের অভাবী মানুষদের সাহায্যকারী হবে। একজন
মুসাফির যে জনপদেই যাবে নিজেকে অতিথি বৎসল লোকদের মধ্যেই দেখতে পাবে। সমাজে অধিকারের
ধারণা এত বেশী ব্যাপক হবে যে, প্রত্যেক ব্যক্তি যাদের মধ্যে
অবস্থান করে নিজের ব্যক্তি-সত্তা ও ধন-সম্পদের ওপর তাদের সবার অধিকার অনুভব করবে। তাদের
খিদমত করার সময় এ ধারণা নিয়েই খিদমত করবে যে, সে তাদের অধিকার
আদায় করছে, তাদেরকে অনুগ্রহ পাশে আবদ্ধ করছে না। কারোর খিদমত
করতে অক্ষম হলে তার কাছে ক্ষমা চাইবে এবং আল্লাহর বান্দাদের খিদমত করার যোগ্যতা লাভ
করার জন্য আল্লাহর কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা করবে।
ইসলামের ঘোষণাপত্রের এ ধারাগুলোও
শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নৈতিকতার শিক্ষাই ছিল না বরং পরবর্তী সময়ে মদীনা তাইয়্যেবার সমাজে
ও রাষ্ট্রে এগুলোর ভিত্তিতেই ওয়াজিব ও নফল সাদকার বিধানসমূহ প্রদত্ত হয়, অসিয়ত, মীরাস ও ওয়াকফের পদ্ধতি
নির্ধারিত হয়, এতিমের অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়,
প্রত্যেক জনবসতির ওপর মুসাফিরের কমপক্ষে তিনদিন পর্যন্ত মেহমানদারী
করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং এ সঙ্গে
সমাজের নৈতিক ব্যবস্থা কার্যত এমন পর্যায়ে উন্নীত করা হয় যার ফলে সমগ্র সামাজিক পরিবেশে
দানশীলতা, সহানুভূতি ও সহযোগিতার মনোভাব সঞ্চারিত হয়ে যায়।
এমনকি লোকেরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে আইনগত অধিকারসমূহ দেয়া ছাড়াও আইনের জোরে যেসব নৈতিক
অধিকার চাওয়া ও প্রদান করা যায় না সেগুলো ও উপলদ্ধি ও আদায় করতে থাকে।
২৯. “হাত বাঁধা” একটি রূপক
কথা। কৃপণতা অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর “হাত খোলে ছেড়ে দেয়া”র মানে হচ্ছে, বাজে খরচ করা। ৪র্থ ধারার সাথে ৬ষ্ঠ ধারাটির এ বাক্যাংশটি মিলিয়ে পড়লে এর
পরিষ্কার অর্থ এই মনে হয় যে, লোকদের মধ্যে এতটুকু ভারসাম্য
হতে হবে যাতে তারা কৃপণ হয়ে অর্থের আবর্তন রুখে না দেয় এবং অপব্যয়ী হয়ে নিজের অর্থনৈতিক
শক্তি ধ্বংস না করে ফেলে। এর বিপরীত পক্ষে তাদের মধ্যে ভারসাম্যের এমন সঠিক অনুভূতি
থাকতে হবে যার ফলে তারা যথার্থ ব্যয় থেকে বিরত হবে না আবার অযথা ব্যয়জনিত ক্ষতির ও
শিকার হবে না। অহংকার ও প্রদর্শনেচ্ছামূলক এবং লোক দেখানো খরচ, বিলাসিতা, ফাসেকী ও অশ্লীল কাজে ব্যয় এবং এমন যাবতীয়
ব্যয় যা মানুষের প্রকৃত প্রয়োজনেও কল্যাণমূলক কাজে লাগার পরিবর্তে ধন-সম্পদ ভুল পথে
নিয়োজিত করে, তা আসলে আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার ছাড়া আর কিছুই
নয়। যারা এভাবে নিজেদের ধন-দৌলত খরচ করে তারা শয়তানের ভাই।
এ ধারাগুলোও নিছক নৈতিক শিক্ষা
এবং ব্যক্তিগত হেদায়াত পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। বরং এদিকে পরিষ্কার ইঙ্গিত করছে যে, একটি সৎ ও সত্যনিষ্ঠ সমাজকে নৈতিক অনুশীলন, সামষ্টিক চাপ প্রয়োগ ও আইনগত বাধা-নিষেধ আরোপের মাধ্যমে অযথা অর্থ ব্যয়
থেকে বিরত রাখা উচিত। এ কারণেই পরবর্তীকালে মদীনা রাষ্ট্রে বিভিন্ন কার্যকর পদ্ধতিতে
এ উভয় ধারা নিখুঁতভাবে প্রয়োগ করা হয়। প্রথমত অপব্যয় ও বিলাসিতার বহু নীতি প্রথাকে
আইনগতভাবে হারাম করা হয়। দ্বিতীয়ত কৌশল অবলম্বন করে অযথা অর্থব্যয়ের পথ বন্ধ করা হয়।
তৃতীয়ত সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে এমন বহু রসম-রেওয়াজের বিলোপ সাধন করা হয় যেগুলোতে অপব্যয়
করা হতো। তারপর রাষ্ট্রকে বিশেষ ক্ষমতা বলে এবং বিশেষ ব্যবস্থাপনা বিধান জারী করে সুস্পষ্ট
অপব্যয়ের ক্ষেত্রে বাধা দেয়ার ইখতিয়ার দেয়া হয়। এভাবে যাকাত ও সাদকার বিধানের মাধ্যমে
কৃপণতার শক্তিতে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় এবং লোকেরা সম্পদ পুঞ্জীভূত করে অর্থের আবর্তনের পথ
বন্ধ করে দেবে এ সম্ভাবনা ও নির্মূল করে দেয়া হয়। এসব কৌশল অবলম্বন করার সাথে সাথে
সমাজে এমন একটি সাধারণ জনমত সৃষ্টি করা হয়, যা দানশীলতা ও
অপব্যয়ের মধ্যকার পার্থক্য সঠিকভাবে জানতো এবং কৃপণতা ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যয়ের মধ্যে
ভালভাবেই ফারাক করতে পারতো। এ জনমত কৃপণদেরকে লাঞ্ছিত করে, ব্যয়ের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষাকারীদেরকে মর্যাদাশালী করে, অপব্যয়কারীদের নিন্দা করে এবং দানশীলদেরকে সমগ্র সমাজের খোশবুদার ফুল হিসেবে
কদর করে। সে সময়ের নৈতিক ও মানসিক প্রশিক্ষণের প্রভাব আজও মুসলিম সমাজে রয়েছে। আজও
দুনিয়ার সব দেশেই মুসলমানরা কৃপণ ও সম্পদ পুঞ্জীভূতকারীদেরকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখে এবং
দানশীলরা আজও তাদের চোখে সম্মানিত ও মর্যাদা সম্পন্ন।
৩০. অর্থাৎ মহান আল্লাহ নিজের
বান্দাদের মধ্যে রিযিক কমবেশী করার ক্ষেত্রে যে পার্থক্য রেখেছেন তার উপযোগিতা বুঝা
মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই রিযিক বন্টনের যে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা রয়েছে কৃত্রিম
মানবিক কৌশলের মাধ্যমে তার মধ্যে হস্তক্ষেপ না করা উচিত। প্রাকৃতিক অসাম্যকে কৃত্রিম
সাম্যে পরিবর্তিত করা অথবা এ অসাম্যকে প্রাকৃতিক সীমার চৌহদ্দী পার করিয়ে বেইনসাফীর
সীমানায় পৌঁছিয়ে দেয়া উভয়টিই সমান ভুল। একটি সঠিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অবস্থান আল্লাহ
নির্ধারিত রিযিক বন্টন পদ্ধতির নিকটতরই হয়ে থাকে।
এ বাক্যে প্রাকৃতিক আইনের
যে নিয়মটির দিকে পথনির্দেশ করা হয়েছিল তার কারণে মদীনার সংস্কার কর্মসূচীতে এ ধারণাটি
আদতে কোন ঠাঁই করে নিতে পারেনি যে, রিযিক ও রিযিকের উপায়-উপকরণগুলোর মধ্যে পার্থক্য ও শ্রেষ্ঠত্ব আসলে এমন
কোন অকল্যাণকর বিষয় নয়, যাকে বিলুপ্ত করা এবং একটি শ্রেণীহীন
সমাজ গঠন করা কোন পর্যায়ে কাংখিত হতে পারে। পক্ষান্তরে সৎকর্মশীলতা ও সদাচারের ভিত্তিতে
মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির বুনিয়াদ কায়েম করার জন্য মদীনা তাইয়্যেবায় এক বিশেষ কর্মপদ্ধতি
অবলম্বন করা হয়। সে কর্মপদ্ধতি ছিল এই যে, আল্লাহর প্রকৃতি
মানুষের মধ্যে যে পার্থক্য করে রেখেছে তাকে আসল প্রাকৃতিক অবস্থায় অপরিবর্তিত রাখতে
হবে এবং ওপরে প্রদত্ত পথনির্দেশনা অনুযায়ী সমাজের নৈতিকতা, আচার-আচরণ ও কর্মবিধানসমূহ এমনভাবে সংশোধন করে দিতে হবে, যার ফলে জীবিকার পার্থক্য ও ব্যবধান কোন জুলুম ও বেইনসাফির বাহনে পরিণত
হবার পরিবর্তে এমন অসংখ্য নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও তামাদ্দুনিক
কল্যাণ ও সমৃদ্ধির বাহনে পরিণত হবে, যে জন্য মূলত বিশ¡জাহানের স্রষ্টা তাঁর বান্দাদের মধ্যে এ পার্থক্য ও ব্যবধান
সৃষ্টি করে রেখেছেন।
৩১. যেসব অর্থনৈতিক চিন্তাধারার
ভিত্তিতে প্রাচীনকাল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত যুগে যুগে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন আন্দোলন
দানা বেঁধেছে, এ আয়াতটি তার ভিত পুরোপুরি
ধ্বসিয়ে দিয়েছে। প্রাচীন যুগে দারিদ্র্য ভীতি শিশু হত্যা ও গর্ভপাতের কারণ হতো। আর
আজ তা দুনিয়াবাসীকে তৃতীয় আর একটি কৌশল অর্থাৎ গর্ভনিরোধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু
ইসলামের ঘোষণাপত্রের এ ধারাটি তাকে অন্নগ্রহণকারীদের সংখ্যা কামাবার ধ্বংসাত্মক প্রচেষ্টা
ত্যাগ করে এমনসব গঠনমূলক কাজে নিজের শক্তি ও যোগ্যতা নিয়োগ করার র্নিদেশ দিচ্ছে যেগুলোর
মাধ্যমে আল্লাহর তৈরী প্রাকৃতিক বিধান অনুযায়ী রিযিক বৃদ্ধি হয়ে থাকে। এ ধারাটির দৃষ্টিতে
অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণের স্বল্পতার আশংকায় মানুষের বারবার সন্তান উৎপাদনের সিলসিলা বন্ধ
করে দিতে উদ্যত হওয়া তার বৃহত্তম ভুলগুলোর অন্যতম হিসেবে চিহিœত হয়েছে। এ ধারাটি
মানুষকে এ বলে সাবধান করে দিচ্ছে যে, রিযিক পৌঁছাবার ব্যবস্থাপনা তোমার আয়ত্বাধীন নয় বরং এটি এমন এক আল্লাহর
আয়ত্বাধীন যিনি তোমাকে এ যমীনে আবাদ করেছেন। পূর্বে আগমনকারীদেরকে তিনি যেভাবে রুজি
দিয়ে এসেছেন তেমনিভাবে তোমাদেরকেও দেবেন। ইতিহাসের অভিজ্ঞতাও একথাই বলে, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা যতই বৃদ্ধি হতে থেকেছে ঠিক সেই পরিমাণে বরং
বহুসময় তার চেয়ে অনেক বেশী পরিমাণে অর্থনৈতিক উপায় উপকরণ বেড়ে গিয়েছে। কাজেই আল্লাহর
সৃষ্টি ব্যবস্থাপনায় মানুষের অযথা হস্তক্ষেপ নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এ শিক্ষার ফলেই কুরআন নাযিলের
যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন যুগে মুসলমানদের মধ্যে জন্ম শাসনের কোন ব্যাপক ভাবধারা
জন্ম লাভ করতে পারেনি।
৩২. “যিনার কাছেও যেয়ো না” এ হুকুম ব্যক্তির জন্য এবং সামগ্রিকভাবে সমগ্র সমাজের জন্যও।
ব্যক্তির জন্য এ হুকুমের মানে হচ্ছে, সে নিছক যিনার কাজ থেকে
দূরে থেকেই ক্ষান্ত হবেনা বরং এ পথের দিকে টেনে নিয়ে যায় যিনার এমন সব সূচনাকারী এবং
প্রাথমিক উদ্যোগ ও আকর্ষণ সৃষ্টিকারী বিষয় থেকেও দূরে থাকবে। আর সমাজের ব্যাপারে বলা
যায়, এ হুকুমের প্রেক্ষিতে সমাজ জীবনে যিনা, যিনার উদ্যোগ আকর্ষণ এবং তার কারণসমূহের পথ বন্ধ করে দেয়া সমাজের জন্য ফরয়
হয়ে যাবে। এ উদ্দেশ্যে সে আইন প্রণয়ন, শিক্ষা ও অনুশীলন দান,
সামাজিক পরিবেশের সংস্কার সাধন, সমাজ জীবনের
যথাযোগ্য বিন্যাস এবং অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।
এ ধারাটি শেষ পর্যন্ত ইসলামী
জীবন ব্যবস্থার একটি বৃহত্তম অধ্যায়ের বুনিয়াদে পরিণত হয়। এর অভিপ্রায় অনুযায়ী যিনা
ও যিনার অপবাদকে ফৌজদারী অপরাধ গণ্য করা হয়। পর্দার বিধান জারী করা হয়। অশ্লীলতা ও
নির্লজ্জতার প্রচার কঠোরভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। মদ্যপান, নাচ, গান ও ছবির (যা যিনার নিকটতম
আত্মীয়) ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। আর এর সংগে এমন একটি দাম্পত্য আইন প্রণয়ন
করা হয় যার ফলে বিবাহ সহজ হয়ে যায় এবং এ যিনার সামাজিক কারণসমূহের শিকড় কেটে যায়।
৩৩. “যাকে হত্যা” মানে কেবলমাত্রে
অন্য ব্যক্তিকে হত্যা করাই নয়, নিজেকে হত্যা করাও এর অন্তর্ভুক্ত।
কারণ মানুষকে মহান আল্লাহ মর্যাদা সম্পন্ন করেছেন। অন্যের প্রাণের সাথে সাথে মানুষের
নিজের প্রাণও এ সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। কাজেই মানুষ হত্যা যত বড় গুনাহ ও অপরাধ,
আত্মহত্যা করাও ঠিক তত বড় অপরাধ ও গুনাহ। মানুষ নিজেকে নিজের প্রাণের
মালিক এবং এ মালিকানাকে নিজ ক্ষমতায় খতম কর দেবার অধিকার রাখে বলে মনে করে,
এটা তার একটা বিরাট ভুল ধারণা। অথচ তার এ প্রাণ আল্লাহর মালিকানাধীন
এবং সে একে খতম করে দেয়া তো দূরের কথা একে কোন অনুপযোগী কাজে ব্যবহার করার অধিকারও
রাখে না। দুনিয়ার এ পরীক্ষাগৃহে আল্লাহ যেভাবেই আমাদের পরীক্ষা নেন না কেন,
পরীক্ষার অবস্থা ভাল হোক বা মন্দ হোক, সেভাবেই
শেষ সময় পর্যন্ত আমাদের পরীক্ষা দিতে থাকা উচিত। আল্লাহর দেয়া সময়কে ইচ্ছা করে খতম
করে দিয়ে পরীক্ষাগৃহ থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করা একটি ভ্রান্ত পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই
নয়। আবার এ পালিয়ে যাবার কাজটিও এমন এক অপরাধের মাধ্যমে সম্পন্ন করা যাকে আল্লাহ সুস্পষ্ট
ভাষায় হারাম গণ্য করেছেন,এটা তো কোনক্রমেই গ্রহণীয় হতে পারে
না। অন্য কথায় বলা যায়, দুনিয়ার ছোট ছোট কষ্ট, লাঞ্ছনা ও অপমানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মানুষ বৃহত্তর ও চিরন্তন
কষ্ট ও লাঞ্ছনার দিকে পালিয়ে যাচ্ছে।
৩৪. পরবর্তীকালে ইসলামী আইন
‘সত্য সহকারে হত্যা’ কে শুধুমাত্র পাঁচটি ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়। এক:
জেনে বুঝে হত্যাকারী থেকে কিসাস নেয়া। দুই: আল্লাহর সত্য দ্বীনের পথে বাধাদানকারীর
বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। তিন: ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা উৎখাত করার প্রচেষ্টাকারীদের
শাস্তি দেয়া, চার: বিবাহিত পুরুষ ও নারীকে ব্যভিচারে লিপ্ত
হওয়ার শাস্তি দেয়া। পাঁচ: মুরতাদকে শাস্তি দেয়া। শুধুমাত্র এ পাঁচটি ক্ষেত্রে মানুষের
প্রাণের মর্যাদা তিরোহিত হয় এবং তাকে হত্যা করা বৈধ গণ্য হয়।
৩৫. মূল শব্দ হচ্ছে, “তার অভিভাবককে আমি সুলতান দান করেছি”। এখানে সুলতান অর্থ হচ্ছে ‘প্রমাণ’ যার ভিত্তিতে
সে কিসাস দাবী করতে পারে। এ থেকে ইসলামী আইনের এ মূলনীতি বের হয় যে, হত্যা মোকাদ্দমার আসল বাদী সরকার নয়। বরং নিহত ব্যক্তির অভিভাবকগণই এর মূল
বাদীপক্ষ। তারা হত্যাকারীকে মাফ করে দিতে এবং কিসাসের পরিবর্তে রক্তপণ গ্রহণ করতে সম্মত
হতে পারে।
৩৬. হত্যার ব্যাপারে বিভিন্নভাবে
সীমা অতিক্রম করা যেতে পারে। এগুলো সবই নিষিদ্ধ। যেমন প্রতিশোধ গ্রহণ করতে গিয়ে উন্মত্তের
মতো অপরাধী ছাড়া অন্যদেরকেও হত্যা করা। অথবা অপরাধীকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে মেরে ফেলা। কিংবা
মেরে ফেলার পর তার লাশের ওপর মনের ঝাল মেটানো। অথবা রক্তপণ নেবার পর আবার তাকে হত্যা
করা ইত্যাদি।
৩৭. যেহেতু সে সময় পর্যন্ত
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাই কে
তাকে সাহায্য করবে, একথা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। পরে যখন ইসলামী
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন ফয়সালা করে দেয়া হয় যে, তাকে
সাহায্য করা তার গোত্র বা সহযোগী বন্ধু দলের কাজ নয় বরং এটা হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র এবং
তার বিচার ব্যবস্থার কাজ। কোন ব্যক্তি বা দল নিজস্বভাবে হত্যার প্রতিশোধ নেবার অধিকার
রাখে না। বরং এটা ইসলামী সরকারের দায়িত্ব। ন্যায় বিচার লাভ করার জন্য তার কাছে সাহায্য
চাওয়া হবে।
৩৮. এটিও নিছক একটি নৈতিক
নির্দেশনামা ছিল না। বরং পরবর্তীকালে যখন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এতিমদের
অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য প্রশাসনিক ও আইনগত উভয় ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়। এর বিস্তারিত
বিবরণ আমরা হাদীস ও ফিকাহর কিতাবগুলোতে পাই। তারপর এখান থেকে এ ব্যাপক ভিত্তিক মূলনীতি
গ্রহণ করা হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের
যেসব নাগরিক নিজেরা তাদের নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা রাখে না।
রাষ্ট্রই তাদের স্বার্থের সংরক্ষক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: (যার
কোন অভিভাবক নেই আমি তার অভিভাবক) এ হাদীসটি এদিকেই ইংগিত করে এবং এ ইসলামী আইন একটি
বিস্তৃত অধ্যায়ের ভূমিকা রচনা করে।
৩৯. এটিই নিছক ব্যক্তিগত নৈতিকতারই
একটি ধারা ছিল না। বরং যখন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তখন একেই সমগ্র জাতির আভ্যন্তরীণ
ও বৈদেশিক রাজনীতির ভিত্তি প্রস্তর গণ্য করা হয়।
৪০. এ নির্দেশটাও নিছক ব্যক্তিবর্গের
পারস্পরিক লেনদেন পর্যন্তসীমাবদ্ধ নয় বরং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর হাট, বাজার ও দোকানগুলোতে মাপজোক ও দাঁড়িপাল্লাগুলো তত্বাবধান
করা এবং শক্তি প্রয়োগ করে ওজনে ও মাপে কম দেয়া বন্ধ করা রাষ্ট্রের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত
হয়ে যায়। তারপর এখান থেকেই এ ব্যাপক মূলনীতি গৃহীত হয় যে, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সব রকমের বেঈমানী ও অধিকার
হরণের পথ রোধ করা সরকারের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
৪১. অর্থাৎ দুনিয়া ও আখেরাত
উভয় স্থানেই। দুনিয়ায় এর শুভ পরিণামের কারণ হচ্ছে এই যে, এর ফলে পারস্পরিক আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্রেতা ও বিক্রেতা
দু’জন দু’জনের ওপর ভরসা
করে, এর ফলে ব্যবসায়ে উন্নতি আসে এবং ব্যাপক
সমৃদ্ধি দেখা দেয়। অন্যদিকে আখেরাতে এর শুভ পরিণাম পুরোপুরি নির্ভর করে ঈমান ও আল্লাহ
ভীতির ওপর।
৪২. এ ধারাটির অর্থ হচ্ছে
লোকেরা নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ধারণা ও অনুমানের পরিবর্তে ‘জ্ঞানের’ পেছনে চলবে।
ইসলামী সমাজে এ ধারাটির প্রয়োগ ব্যাপকভাবে নৈতিক ব্যবস্থায়, আইনে, রাজনীতিতে, দেশ
শাসনে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কারিগরী বিদ্যায় এবং শিক্ষা ব্যবস্থায়
তথা জীবনের সকল বিভাগে সুষ্ঠুভাবে করা হয়েছে। জ্ঞানের পরিবর্তে অনুমানের পেছনে চালার
কারণে মানুষের জীবনে যে অসংখ্য দুষ্ট মতের সৃষ্টি হয় তা থেকে চিন্তা ও কর্মকে মুক্ত
করে দেয়া হয়েছে। নৈতিকতার ক্ষেত্রে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কু-ধারণা
থেকে দূরে থাকো এবং কোন ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে কোন প্রকার অনুসন্ধান ছাড়াই কোন দোষারোপ
করো না। আইনের ক্ষেত্রে এ মর্মে একটি স্থায়ী মূলনীতিই স্থির করে দেয়া হয়েছে যে,
নিছক সন্দেহ বশত কারো বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে না। অপরাধ
তদন্তের ক্ষেত্রে নীতি নির্দেশ করা হয়েছে যে, অনুমানের ভিত্তিতে
কাউকে গ্রেফতার, মারধর বা জেলে আটক করা সম্পূর্ণ অবৈধ। বিজাতিদের
সাথে আচার আচরণের ক্ষেত্রে এ নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে যে, অনুসন্ধান ছাড়া কারোর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে না এবং নিছক সন্দেহের
ভিত্তিতে কোন গুজব ছড়ানোও যাবে না। শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও যেসব তথাকথিত জ্ঞান
নিছক আন্দাজ-অনুমান এবং দীর্ঘসূত্রীতাময় ধারণা ও কল্পনা নির্ভর, সেগুলোকেও অপছন্দ করা হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই যে, আক্বীদা বিশ¡াসের ক্ষেত্রে
ধারণা, কল্পনা ও কুসংস্কারের মূল উপড়ে ফেলা হয়েছে
এবং ঈমানদারদেরকে শুধুমাত্র আল্লাহ ও রাসূল প্রদত্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে প্রমাণিত বিষয়
মেনে নেবার শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
৪৩. এর মানে হচ্ছে, ক্ষমতাগর্বী ও অহংকারীদের মতো আচরণ করো না। এ নির্দেশটি
ব্যক্তিগত কর্মপদ্ধতি ও জাতীয় আচরণ উভয়ের ওপর সমানভাবে প্রযোজ্য। এ নির্দেশের বদৌলতেই
এ ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে মদীনা তাইয়্যেবায় যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তার শাসকবৃন্দ,
গভর্নর ও সিপাহসালারদের জীবনে ক্ষমতাগর্ব ও অহংকারের ছিঁটেফোটাও ছিল
না। এমনকি যুদ্ধরত অবস্থায়ও কখনো তাদের মুখ থেকে দম্ভ ও অহংকারের কোন কথাই বের হতো
না। তাদের ওঠা বসা, চাল-চলন, পোশাক-পরিচ্ছদ,
ঘর-বাড়ি, সওয়ারী ও সাধারণ আচার-আচরণের নম্রতা
ও কোমলতা বরং ফকিরী ও দরবেশীর ছাপ স্পষ্ট দেখা যেতো। যখন তারা বিজয়ীর বেশে কোন শহরে
প্রবেশ করতেন তখনও দর্প ও অহংকার সহকারে নিজেদের ভীতি মানুষের মনে বসিয়ে দেবার চেষ্টা
করতেন না।
৪৪. অর্থাৎ এগুলোর মধ্য থেকে
যেগুলোই নিষিদ্ধ সেগুলো করা আল্লাহ অপছন্দ করেন। অথবা অন্য কথায় বলা যায়, আল্লাহর যে কোন হুকুম অমান্য করা অপছন্দীয় কাজ।
৪৫. আপাতদৃষ্টে এখানে নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের অবস্থায় মহান
আল্লাহ নিজের নবীকে সম্বোধন করে যে কথা বলেন তা আসলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সম্বোধন করে
বলা হয়।
৪৬. এ সম্পর্কে সূরা নাহলে
বলা হয়েছে: আরব মুশরিকদের মাবুদদের মধ্যে দেবতাদের সংখ্যা ছিল কম, দেবীদের সংখ্যা ছিল বেশী ৷ আর এ দেবীদের সম্পর্কে তাদের
আকীদা ছিল এই যে, তারা আল্লাহর মেয়ে ৷ এভাবে ফেরেশতাদেরকেও
তারা আল্লাহর মেয়ে গণ্য করতো ৷ যে কন্যা সন্তানকে তারা নিজেদের জন্য এত বেশী লজ্জাজনক
মনে করে থাকে, সেই কন্যা সন্তানকে আল্লাহর জন্য মনোনীত করতে
তাদের কোনই দ্বিধা হয় না ৷ অথচ আল্লাহর আদৌ কোন সন্তান থাকতে পারে এরূপ ধারণা করা একটি
মহামূর্খতা ও চরম বেয়াদবী ছাড়া আর কিছুই নয় ৷ আরব মুশরিকদের এ কর্মনীতিকে এখানে একটি
বিশেষ দিক দিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে ৷ এর উদ্দেশ্য আল্লাহ সম্পর্কে তাদের নিম্নমুখী
চিন্তা-ভাবনা সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা এবং তাদেরকে এ কথা বলে দেয়া যে, মুশরিকী আকীদা-বিশ্বাস আল্লাহর ব্যাপারে তাদেরকে দুঃসাহসী ও ঔদ্ধত্যশালী
বানিয়ে দিয়েছে, যার ফলে তারা এতই বিকারগ্রস্ত ও অনুভূতিহীন
হয়ে পড়েছে যে, এ ধরনের কথা বলা তারা একটুও দোষণীয় মনে করে
না ৷
বিষয়ভিত্তিক হাদীস:
১৮
عَنْ أَبِي
هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنْ رَجُلًا قَالَ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّم أَوْصِنِي. قَالَ: لَا تَغْضَبْ، فَرَدَّدَ مِرَارًا، قَالَ: لَا تَغْضَبْ"
.[رَوَاهُ الْبُخَارِيُّ:]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু
আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে- এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলল: আমাকে কিছু উপদেশ দিন। তিনি বললেন: রাগ করো
না। লোকটি বার বার রাসূলের নিকট উপেদশ চায় আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন: রাগ করো না। [বুখারী]মুখস্ত করণ: ষষ্ঠ
আয়াত
১৬-১৮ রামাদান: ৩
দিন
قُلْ إِنْ
كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ
وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا
أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا
حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ (২৪)
২৪) হে নবী! বলে দাও, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান ও
তোমাদের ভাই তোমাদের স্ত্রী,তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত সম্পদ, তোমাদের যে ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দেয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাক এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে
তোমরা খুবই পছন্দ কর, এসব যদি আল্লাহ ও
তাঁর রাসূল এবং তার পথে জিহাদ করার চাইতে তোমাদের কাছে বেশী প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফয়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর।
আল্লাহ ফাসেকদেরকে কখনো সত্য পথের সন্ধান দেন না।
সূরা তাওবা : ২৪
মুখস্থকরণ: তৃতীয়
হাদীস
১৫-১৯ রামাদান
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيّ
رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْت رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم
يَقُولُ: "مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ
يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ
الْإِيمَانِ" . رَوَاهُ مُسْلِمٌ
আবূ সাঈদ খুদরী (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে কেউ কোন অন্যায় দেখলে তা
সে তার হাত দ্বারা প্রতিহত করবে, যদি তা সম্ভব না হয় তবে মুখ
দ্বারা প্রতিহত করবে, তাও যদি না করতে পারে তাহলে অন্তর দিয়ে
তা ঘৃণা করবে। আর এ হচ্ছে (অন্তর দিয়ে প্রতিহত করা) দুর্বলতম ঈমান”। মুসলিম
(স্মরণ
করি-২৭৩ পর্ব)
WAMY BANGLADESH
Pioneer Organization for
Distinguished Youth
এটি
ওয়ার্ল্ড এসেম্বলী অফ মুসলিম ইয়ুথ (ওয়ামী), বাংলাদেশ অফিসের মিডিয়া ডিপার্টমেন্টের উদ্যোগে একটি কার্যক্রম ।
কুরআন ও হাদীসের মহান বাণী, সম সাময়িক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যূ- নিয়ে সাজানো ।
উদ্দেশ্য সর্বস্তরের
মানুষের সাথে সম্পর্কের দৃঢ়
বন্ধন তৈরী করা। বিস্তারিত
জানতে মেইল করুন wamybangladesh@gmail.com অথবা
ভিজিট করুন http://www.ohioftruth.blogspot.com/
or http://www.facebook.com/Daily.OHI